-মোহাম্মদ আবদুর রহীম 
                        বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির পথচলা এবং এর প্রতিষ্ঠায় 
যেসব প্রতিষ্ঠান ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে, বাংলা সাহিত্য পরিষদ সেগুলোর 
মধ্যে অন্যতম। 
আমরা জানি, ক্যালিগ্রাফি একটি সুপ্রাচীন শিল্পমাধ্যম এবং 
হাজার বছর ধরে মুসলমানরা একে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশে 
সুলতানি আমল ও মোগল আমলের পর '৮০-এর দশকে এসে পুনরায় এ শিল্পটির চর্চা 
জোরে-শোরে শুরু হয়। প্রথমে ব্যক্তি পর্যায়ে এবং অল্প সময় পরে ক্যালিগ্রাফির
 সংগঠন গড়ে ওঠে। ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
 বাংলা সাহিত্য পরিষদ ক্যালিগ্রাফির লেখক এবং শিল্পী তৈরিতে প্রথম পর্যায়ে 
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। '৯০-এর দশকে রাজধানীর মগবাজার ডাক্তারের 
গলিতে সাহিত্য পরিষদ কার্যালয়ে আমরা কয়েকজন তরুণ আমাদের উস্তাদ আবদুল 
মান্নান সৈয়দের অমূল্য রত্নসম ক্লাসগুলোতে বুভুক্ষের মতো হাজির হতাম। সেই 
ক্লাসগুলো ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন এবং 
লেখালেখিতে প্রেরণা যোগায়। 
অবশ্য '৮০-এর দশক থেকে আমার ক্যালিগ্রাফিচর্চা 
শুরু। বাংলা সাহিত্য পরিষদের কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে ঋণী এবং এর প্রতি 
আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। শুধু সাহিত্য নয়, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ করে 
শিল্পকলায় সম্পূর্ণ নতুন একটি পথ রচনায় এ প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রেখেছে। 
অবশ্য 
সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের অবদানও উল্লেখ্য। '৯০-এর দশকে আমাদের চোখে যে 
স্বপ্নের অঞ্জন মেখে দিয়েছিল সাহিত্য পরিষদ, আজ তা যৌবনে পদার্পণ করেছে। এই
 প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির প্রতিষ্ঠায় এবং পথচলায় নীরব সহায়তা 
দিয়েছে। এমনকি ক্যালিগ্রাফির লেখক তৈরিতে এর সাহিত্য সভা যে গুরুত্বপূর্ণ 
ভূমিকা রেখেছে, তা অনস্বীকার্য ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
 আজ শুধু দেশে নয় 
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি সগৌরবে মাথা উঁচু করে 
দাঁড়িয়েছে এবং দেশের জন্য সুনাম ও মর্যাদা বয়ে এনেছে, সে পরিপ্রেক্ষিত 
রচনায় এ প্রতিষ্ঠানের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা যায়। দেশে একদল 
তরুণ সম্ভাবনাময় ক্যালিগ্রাফার তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণের জায়গা 
হিসেবে সাহিত্য পরিষদ দীর্ঘ সময় ধরে সহায়তা প্রদান করেছে। 
প্রায় একযুগ 
বাংলা সাহিত্য পরিষদের মিলনায়তনে ক্যালিগ্রাফির প্রশিক্ষণক্লাস অনুষ্ঠিত 
হয়েছে এবং ক্যালিগ্রাফির প্রতি এ প্রতিষ্ঠানের ভালোবাসা ও মমত্ববোধের পরিচয়
 হচ্ছে প্রশিক্ষণ ক্লাসের জন্য মিলনায়তনকে বিনা ভাড়ায় ব্যবহার করতে 
দিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। 
বর্তমানে তরুণ ক্যালিগ্রাফিশিল্পীদের অধিকাংশই এ 
প্রশিক্ষণ ক্লাসের ফসল। বিখ্যাত উস্তাদ শহীদুল্লাহ এফ. বারী ছাত্রদের 
ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফির তালিম দিতেন এসব ক্লাসে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় 
ক্যালিগ্রাফির ওয়ার্কশপ, সংবর্ধনা, সেমিনার প্রভৃতি অনুষ্ঠান এ 
প্রতিষ্ঠানের মিলনায়তনে বিনা ভাড়ায় করা সম্ভব হয়েছে।
প্রতি বছর বিভিন্ন 
দেশে প্রদর্শনী, ফেস্টিভ্যাল প্রভৃতি অনুষ্ঠানে আমাদের 
ক্যালিগ্রাফিশিল্পীরা অংশগ্রহণ করছেন, অ্যাওয়ার্ড অর্জন এবং প্রশংসিত 
হচ্ছেন, তা বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির বড় ধরনের অগ্রগতি এবং উন্নয়নের প্রমাণ
 বহন করে। ইসলামী শিল্পকলার প্রধান মাধ্যম হিসেবে ওআইসির কালচারাল বিভাগ 
ইরসিকা(IRCICA) আজ মুসলিম বিশ্বে ক্যালিগ্রাফিকে পুন:প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের প্রয়াস 
চালিয়ে যাচ্ছে। খুশির খবর হচ্ছে, সেই কার্যক্রমের সাথে আমাদের 
ক্যালিগ্রাফিশিল্পীরা অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। 
বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির আজকের এই গৌরবময় অর্জন ও মর্যাদা লাভের পেছনে 
বাংলা সাহিত্য পরিষদের বড় ধরনের অংশীদারিত্ব রয়েছে। সামাজিক আচার-আচরণকে 
পরিশীলিত ও রুচিবোধকে উন্নত করতে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ 
ভূমিকা রেখে থাকে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, '৮০-এর দশকে এদেশে আমজনতার 
চিত্ত বিনোদনের জন্য যেসব প্রকাশনা, বিশেষ করে ক্যালেন্ডার, ভিউকার্ড, ঘরের
 দেয়ালশোভিত করার চিত্রকর্ম বা ছবি প্রভৃতিতে সিনেমার নায়িকাদের চিত্র 
ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হত। 
আজ সেখানে ক্যালিগ্রাফি কিংবা প্রাকৃতিক 
দৃশ্যাবলী ব্যবহার হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে 
ব্যক্তিগতভাবে বিয়ের অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন পর্যায়ে উপহার হিসেবে 
ক্যালিগ্রাফিকে আমল দেয়া হচ্ছে। এমনকি সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সুসংবাদ 
আত্মীয়-পরিজনের কাছে দেয়ার সময় মিষ্টির সাথে ক্যালিগ্রাফি পাঠানোর মত ঘটনা 
ঘটেছে। 
ক্যালিগ্রাফি একটি পরিবারকে যে ইসলামের সুশীতল পরিবেশ ও জীবনচর্চায় 
ফিরিয়ে আনতে পারে, সে কথাও আমরা জানতে পেরেছি। এই যে বিশাল পরিবর্তন এবং তা
 অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয় বলে মনে করি। এটার পেছনে যে আন্দোলন গড়ে 
উঠেছে এবং কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলা সাহিত্য পরিষদের অবদান অবশ্যই 
রয়েছে। 
বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির অগ্রযাত্রায় বাংলা সাহিত্য পরিষদ যে 
সহায়তা দিয়েছে, তার মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন এবং ক্যালিগ্রাফির আজকের এই 
অবস্থান তৈরিতে সাহিত্য পরিষদের অকুন্ঠ অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে আমাদের
 বিশ্বাস।                     

No comments:
Post a Comment