Friday, March 9, 2012

বাঙলা ক্যালিগ্রাফি : ভিন্ন এক শিল্প আলেখ্য

ব্লগারের প্রোফাইল ছবি





বাঙলা অক্ষর নিয়ে বাঙালদের ঐতিহ্যচিন্তা এ ভাষার প্রথম পথচলা থেকে শুরু হয়েছে। শুধু প্রয়োজন বলে কথা নয় হৃদয়ের আকুতি এর সাথে মিশে আছে। প্রাচীন পুথিপত্রে লেখাকে সুন্দর আর অলঙ্কার মণ্ডিত করার প্রয়াস বাঙাল ভূখণ্ডে প্রবলভাবে ফুটে ওঠে মধ্যযুগে।



ছাপার হরফে বই আসার পরেও প্রচ্ছদ আর ভেতরের ইলাস্ট্রেশনে বাংলা হরফের শিল্পিত ব্যবহার চালু রয়েছে। কিন্তু হরফ দিয়ে শিল্পকলা করার আবেগ আর স্পৃহা একেবারে হাল আমলের। আমাদের চারুকলায় বাঙলা হরফ দিয়ে লিপিকলা বা ক্যালিগ্রাফি করার কোন ট্রেডিশন দেখা যায় না। বিচ্ছিন্ন দু'একটা কাজ যা আছে তাতে এর প্রতি গভীর অভিনিবেশ প্রায় শুণ্যের কোঠায়।



বাঙলা ক্যালিগ্রাফির বর্তমান যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দুটো প্রধান চরিত্র রয়েছে। এক. বইপত্রে প্রচ্ছদ এবং ইলাস্ট্রেশন, দুই. লিপিকলা।



বইয়ের প্রচ্ছদে শিরোনাম ক্যালিগ্রাফি স্টাইলে লেখার ক্ষেত্রে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হচ্ছেন অগ্রনায়ক। তার তুলির টানে হরফের শিল্পিত অবয়ব একটি ধারার সৃষ্টি করেছে। এ ধারায় যারা কাজ করেছেন তারা প্রায় সবাই চারুকলার।



প্রায় একই রকম হরফের বলিষ্ঠভাব নিয়ে শিল্পী হাশেম খানের তুলির টানে অন্য একটি ধারা দেখা যায়। তবে হাশেম খানের হরফে একটা গ্রামীণ সরল ভাবের সাথে শিশুর সরলতার অসাধারণ বৈশিষ্ট্য অন্যদের মাঝে দেখা যায় না।



আর বাঙলাবাজারে ধর্মীয় বইপত্র এবং সাধারণ পাঠকদের জন্য লেখা বইয়ে আরবি হরফের আদলে বাঙলা হরফে ক্যালিগ্রাফিরও দেখা মেলে।



হাতে লেখা সাইনবোর্ড ও দেয়াল লিখন :

এখন আর হাতে লেখা সাইনবোর্ড প্রায় দেখা যায় না। দুই দশক আগেও চমৎকার আর্টিস্টিক বাঙলা হরফে সাইনবোর্ড লেখা হত। হরফে আলোছায়া আর উচুনিচু ভাবের সাথে শিল্পিত ছোয়া ছিল অসাধারণ। তেমনিভাবে দেয়াল লিখন আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বামপন্থীদের দেয়াল লিখনে যে শিল্পিত রূপ ছিল তা অন্যদের বিমোহিত করত।



একুশে উদযাপন উপলক্ষে শহীদ মিনারের আশেপাশের দেয়াল লিখন এক সময় এত বিচিত্র আর মান সম্পন্ন ছিল যে সৌন্দর্যপিপাসুরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে তা নয়ন ভরে দেখত। চারুকলার ছাত্ররা বরারবর এই লেখাকে তাদের প্রেস্টিজ ইস্যু মনে করত। এখন আর সেই মান নেই।



এক সময় দেয়াল পত্রিকা পাড়া মহল্লায়ও বের করা হত। এখন শিক্ষাঙ্গন থেকেও তা প্রায় হারিয়ে গেছে। এসব লেখালেখিতে হরফকে সুন্দর করার যে প্রয়াস ছিল তাতে শিক্ষিত মাত্রই সুন্দর হাতের লেখার একটা গুরুত্ব ছিল। আর এখন অধিকাংশ ছাত্রের হাতের লেখা দেখলে বাংলা হরফের প্রতি ভালবাসা দূরে থাক যেন হরফকেই তারা ভুলতে বসেছে।




 উল্টো চিত্র:

এই চিত্রের উল্টোদিকও আছে। বাঙলা হরফে ক্যালিগ্রাফি করার একটা প্রয়াস ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। পেইন্টিংয়ে হাশেমখান, কাইয়ুম চৌধুরী আর আবদুস সাত্তার বাঙলা হরফকে অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করছেন। চারুকলার সাম্প্রতিক কাজেও তা প্রভাব ফেলেছে।





অন্যদিকে বলা যায় একাডেমিক শিল্পচর্চার বাইরে কিছু শিল্পী তাদের শিল্পকর্মকে বাংলা ক্যালিগ্রাফি হিসেবে তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের কাজে অভিনিবেশ আর কঠোর সাধনা লক্ষ্য করা যায়।









এসব বাঙলা ক্যালিগ্রাফিতে ধর্মীয় ভাব প্রাধান্য পেয়েছে টেক্সট ব্যবহারের ক্ষেত্রে। তাছাড়া দেশ মাতৃকা ভাষার প্রতি কমিটমেন্টও এসব কাজে দেখা যায়। তবে ক্যালিগ্রাফিতে শিল্পমানে কোন ছাড় দিতে রাজি নয় এসব শিল্পী। সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহীম মণ্ডল, আরিফুর রহমান, আবদুর রহীমসহ প্রায় শতখানেক শিল্পী বাঙলা ক্যালিগ্রাফির একটি নতুন ধারা দাড় করিয়ে ফেলেছেন।

আরহামের পিকটোগ্রাফি:



আরহামুল হক চৌধুরী বাঙলা হরফকে নানান রকম পেচিয়ে বাকিয়ে যেকোন বস্তু বা প্রাণীর চিত্র একেছেন। তার কাজে প্রবাদ প্রবচন এসেছে চিত্রের অবয়ব তৈরিতে সাচ্ছন্দ্যরূপে। ছবির আবেদনের সাথে অবয়ব এবং টেক্সট মিলে একাকার হয়ে গেছে। এধরণের নিরীক্ষাধর্মী কাজে ঐতিহ্যকে ভিন্নভাবে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। যা কিছুটা নগর জীবনের বিলাসের ভেতর লোকশিল্প ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা।

এই হচ্ছে চলমান বাঙলা ক্যালিগ্রাফির চিত্রালেখ্য।


ছবি- নেট ও আমার সংগ্রহশালা থেকে।

বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফিতে বাংলা সাহিত্য পরিষদের অবদান


 -মোহাম্মদ আবদুর রহীম 
 
বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির পথচলা এবং এর প্রতিষ্ঠায় যেসব প্রতিষ্ঠান ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে, বাংলা সাহিত্য পরিষদ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। 
আমরা জানি, ক্যালিগ্রাফি একটি সুপ্রাচীন শিল্পমাধ্যম এবং হাজার বছর ধরে মুসলমানরা একে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশে সুলতানি আমল ও মোগল আমলের পর '৮০-এর দশকে এসে পুনরায় এ শিল্পটির চর্চা জোরে-শোরে শুরু হয়। প্রথমে ব্যক্তি পর্যায়ে এবং অল্প সময় পরে ক্যালিগ্রাফির সংগঠন গড়ে ওঠে। ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
 বাংলা সাহিত্য পরিষদ ক্যালিগ্রাফির লেখক এবং শিল্পী তৈরিতে প্রথম পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। '৯০-এর দশকে রাজধানীর মগবাজার ডাক্তারের গলিতে সাহিত্য পরিষদ কার্যালয়ে আমরা কয়েকজন তরুণ আমাদের উস্তাদ আবদুল মান্নান সৈয়দের অমূল্য রত্নসম ক্লাসগুলোতে বুভুক্ষের মতো হাজির হতাম। সেই ক্লাসগুলো ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন এবং লেখালেখিতে প্রেরণা যোগায়। 
অবশ্য '৮০-এর দশক থেকে আমার ক্যালিগ্রাফিচর্চা শুরু। বাংলা সাহিত্য পরিষদের কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে ঋণী এবং এর প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। শুধু সাহিত্য নয়, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ করে শিল্পকলায় সম্পূর্ণ নতুন একটি পথ রচনায় এ প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রেখেছে। 
অবশ্য সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের অবদানও উল্লেখ্য। '৯০-এর দশকে আমাদের চোখে যে স্বপ্নের অঞ্জন মেখে দিয়েছিল সাহিত্য পরিষদ, আজ তা যৌবনে পদার্পণ করেছে। এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির প্রতিষ্ঠায় এবং পথচলায় নীরব সহায়তা দিয়েছে। এমনকি ক্যালিগ্রাফির লেখক তৈরিতে এর সাহিত্য সভা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তা অনস্বীকার্য ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
 আজ শুধু দেশে নয় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে এবং দেশের জন্য সুনাম ও মর্যাদা বয়ে এনেছে, সে পরিপ্রেক্ষিত রচনায় এ প্রতিষ্ঠানের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা যায়। দেশে একদল তরুণ সম্ভাবনাময় ক্যালিগ্রাফার তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণের জায়গা হিসেবে সাহিত্য পরিষদ দীর্ঘ সময় ধরে সহায়তা প্রদান করেছে। 
প্রায় একযুগ বাংলা সাহিত্য পরিষদের মিলনায়তনে ক্যালিগ্রাফির প্রশিক্ষণক্লাস অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ক্যালিগ্রাফির প্রতি এ প্রতিষ্ঠানের ভালোবাসা ও মমত্ববোধের পরিচয় হচ্ছে প্রশিক্ষণ ক্লাসের জন্য মিলনায়তনকে বিনা ভাড়ায় ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। 
বর্তমানে তরুণ ক্যালিগ্রাফিশিল্পীদের অধিকাংশই এ প্রশিক্ষণ ক্লাসের ফসল। বিখ্যাত উস্তাদ শহীদুল্লাহ এফ. বারী ছাত্রদের ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফির তালিম দিতেন এসব ক্লাসে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ক্যালিগ্রাফির ওয়ার্কশপ, সংবর্ধনা, সেমিনার প্রভৃতি অনুষ্ঠান এ প্রতিষ্ঠানের মিলনায়তনে বিনা ভাড়ায় করা সম্ভব হয়েছে।
প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনী, ফেস্টিভ্যাল প্রভৃতি অনুষ্ঠানে আমাদের ক্যালিগ্রাফিশিল্পীরা অংশগ্রহণ করছেন, অ্যাওয়ার্ড অর্জন এবং প্রশংসিত হচ্ছেন, তা বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির বড় ধরনের অগ্রগতি এবং উন্নয়নের প্রমাণ বহন করে। ইসলামী শিল্পকলার প্রধান মাধ্যম হিসেবে ওআইসির কালচারাল বিভাগ ইরসিকা(IRCICA) আজ মুসলিম বিশ্বে ক্যালিগ্রাফিকে পুন:প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। খুশির খবর হচ্ছে, সেই কার্যক্রমের সাথে আমাদের ক্যালিগ্রাফিশিল্পীরা অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। 
বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির আজকের এই গৌরবময় অর্জন ও মর্যাদা লাভের পেছনে বাংলা সাহিত্য পরিষদের বড় ধরনের অংশীদারিত্ব রয়েছে। সামাজিক আচার-আচরণকে পরিশীলিত ও রুচিবোধকে উন্নত করতে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, '৮০-এর দশকে এদেশে আমজনতার চিত্ত বিনোদনের জন্য যেসব প্রকাশনা, বিশেষ করে ক্যালেন্ডার, ভিউকার্ড, ঘরের দেয়ালশোভিত করার চিত্রকর্ম বা ছবি প্রভৃতিতে সিনেমার নায়িকাদের চিত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হত। 
আজ সেখানে ক্যালিগ্রাফি কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ব্যবহার হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যক্তিগতভাবে বিয়ের অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন পর্যায়ে উপহার হিসেবে ক্যালিগ্রাফিকে আমল দেয়া হচ্ছে। এমনকি সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সুসংবাদ আত্মীয়-পরিজনের কাছে দেয়ার সময় মিষ্টির সাথে ক্যালিগ্রাফি পাঠানোর মত ঘটনা ঘটেছে। 
ক্যালিগ্রাফি একটি পরিবারকে যে ইসলামের সুশীতল পরিবেশ ও জীবনচর্চায় ফিরিয়ে আনতে পারে, সে কথাও আমরা জানতে পেরেছি। এই যে বিশাল পরিবর্তন এবং তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয় বলে মনে করি। এটার পেছনে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলা সাহিত্য পরিষদের অবদান অবশ্যই রয়েছে। 
বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির অগ্রযাত্রায় বাংলা সাহিত্য পরিষদ যে সহায়তা দিয়েছে, তার মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন এবং ক্যালিগ্রাফির আজকের এই অবস্থান তৈরিতে সাহিত্য পরিষদের অকুন্ঠ অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

Tuesday, March 6, 2012

ক্যালিগ্রাফির প্রেমে এলিনূর হল্যান্ড..


ব্লগারের প্রোফাইল ছবি






যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার একটি নিরিবিলি শহরতলি। সেখানে মেয়েটির শৈশব কাটে এক রকম বৈচিত্রহীন পরিবেশে। টিনেজ বয়সটা রঙ আর স্বপ্নে বিভোর। পড়াশুনা করতে করতে তার শুধু মনে হয় দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে।

এক সামারে তার সেই সুযোগ মিলে যায়।

এক তুর্কি পরিবারের আমন্ত্রণে সে ইস্তাম্বুল আসে। এখানে নতুন পরিবেশ, সংস্কৃতি আর একটি বিশেষ ধরণের আর্ট তাকে বিহ্বল করে তোলে। কিশোরী মনে তার দূরের স্বপ্ন জাগে। সে একজন ক্যালিগ্রাফার হবে। আরবি হরফের এই আর্টের প্রেমে সে দিওয়ানা হয়ে যায়। কিশোরীর প্রথম প্রেম বলে কথা!

ঘরে ফিরে কিছুই ভাল লাগে না। সারাদিন সে কালি আর খাগের কলম দিয়ে কাগজে হরফ একে চলে। তুরস্কে ক্ষণকাল আবাসে সে হরফগুলো আঁকা শিখেছিল। এরপর ক্যালিগ্রাফির টানে বহুবার তুরস্কে যেতে হয়েছে তাকে। সেই টিনেজ বয়সেই একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় সে।

ইসলাম গ্রহণ করে নিজের নাম রাখেন এলিনূর আয়েশা হল্যান্ড।



ক্যালিগ্রাফির পাশাপাশি তিনি টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিলিজিয়াস স্টাডিজে বিএ এবং পেনসিলভানিয়া ইউনিতে আরবিতে পড়াশুনা করেন। এছাড়া কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেন্টার ফর এরাবিক স্টাডিজে সামার প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেন।



একটানা কুড়ি বছর ধরে বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে ক্যালিগ্রাফির দীক্ষা নেন। মোহাম্মদ জাকারিয়া আর বাগদাদের উইস্সাম শাওকাত তার ওস্তাদদের অন্যতম।



এলিনূর প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। বিভিন্ন মিউজিয়ামে রক্ষিত আরবি ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম তিনি চর্চা ও প্রতিলিপি করা শুরু করেন। লাতিন হরফের ক্যালিগ্রাফিও এর সাথে আয়ত্ব করেন। বিশেষ করে আরবি ক্যালিগ্রাফির ইতিহাস, উন্নয়ন, ক্রমধারা, প্রয়োগ এবং এর নিগুঢ় কলাকৌশল সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন।



১৯৯৪ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন জাদুঘরে, প্রতিষ্ঠানে ক্যালিগ্রাফির ক্লাস নেয়া শুরু করেন। খুব দ্রুত তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক-বাণিজ্যিক পর্যায়ে তার ক্যালিগ্রাফির সংগ্রহ বেড়ে যায়।



স্মিতোনিয়ান ইনস্টিটিউট, নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি, ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ, নিউইয়র্ক সোসাইটি অব স্ক্রাইব ও লং আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় তিনি ক্যালিগ্রাফি প্রেজেন্টেশন এবং প্রদর্শনি করেছেন।

এছাড়া বৃটিশ মিউজিয়ামে তার ক্যালিগ্রাফি ওয়ার্কশপ শিল্পাঙ্গনে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

বর্তমানে তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির উপকন্ঠে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।



ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে তিনি বলেন, "এমন একটি চমৎকার নান্দনিক শিল্পকলা যে পৃথিবীতে রয়েছে, তা অনেকেই জানেন না। এমনকি এই ইসলামিক ক্যালিগ্রাফিই তাকে দূত হিসেবে অন্যান্য শিল্পকলার কাছে তুলে ধরেছে।"



সাধনা, অধ্যাবসায়, আর প্রগাঢ় শিল্পপ্রেমের এক জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে আমরা এলিনূর আয়েশা হল্যান্ডকে দেখতে পাই। শিল্পাঙ্গনে তিনি উত্তর প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

ছবি-নেট থেকে মারিং

Monday, March 5, 2012

ক্যালিগ্রাফি : নান্দনিকতার ভিন্ন মাত্রা


ব্লগারের প্রোফাইল ছবি




বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি চর্চার বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে পরিপূর্ণ ক্যালিগ্রাফি সেন্টারের প্রথম একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। বিশেষকরে ক্যালিগ্রাফির নান্দনিক দিক নিয়ে অধ্যয়ন এবং ক্যালিগ্রাফির প্রদর্শনীর আয়োজন, ক্যালিগ্রাফি শিল্পী এবং তাদের শিল্পকর্ম নিয়ে প্রথম একটি সামগ্রিক তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা হচ্ছে। এসবের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, একটি ভিন্ন মাত্রার শিল্পকলার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা।

ক্যালিগ্রাফি শিক্ষার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম আরো সৃজনশীল হতে পারে এজন্য ব্যাপকভিত্তিক কর্মশালার আয়োজন করা। এতে শিশুদের সাথে বয়স্করাও ক্যালিগ্রাফির নান্দনিকতা সম্পর্কে জানতে পারবেন।



গবেষকরা বলছেন, ইসলামী ক্যালিগ্রাফি আরবি লিপিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ইসলাম পূর্ব সময়ে মক্কা নগরীতে আরবি লিপি প্রথম প্রচলন করেন বিশর ইবনে আবদুল মালিক আল কিন্দি। তিনি উত্তর আরবের হিরা এবং আনবার অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছ থেকে নাবাতিয়ান লিপি লেখার শৈল্পিক জ্ঞান অর্জন করেন। প্রাচীন তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, আরবরা ইসলামের আগে থেকেই আরবি লিপিতে লেখালেখি করত। এছাড়া সেময় ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা তাদের বইপত্র হিব্রু এবং সিরিয়াক লিপির সাথে আরবিতেও লিখত। সপ্তম শতাব্দীর প্রথম থেকেই আরবি ক্যালিগ্রাফি বিশেষকরে হেজাজে শিল্পিত হয়ে উঠতে থাকে।

আরব উপদ্বীপে ইসলাম প্রসারের সাথে সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্ব পায় আরবি লিপি। পবিত্র কুরআন আরবিতে অবতীর্ণ হওয়ায় আরব-অনারব মুসলমানদের কাছে ইসলামের ভাষা হিসেবে আরবি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সুন্নাহ নথিভুক্ত ও সংরক্ষণের জন্য আরবি লিপির ব্যবহার অনিবার্য হয়ে ওঠে। ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান ও শিক্ষা লাভের জন্য মুসলমানরা আরবিতে পড়া ও লেখার বিষয়ে আগ্রহী। সুতরাং আরবি ক্যালিগ্রাফি খুব দ্রুত উন্নয়ন ও বিকাশ লাভ করেছে। আরবি ক্যালিগ্রাফি আরব বিশ্ব ছাড়িয়ে অনারব দেশগুলোতে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এটা এখন এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, আরবি ক্যালিগ্রাফির শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যে অন্যান্য দৃশ্যমান শিল্পকলার শীর্ষমানের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। গবেষকরা আরবি ক্যালিগ্রাফিকে ’লিভিং আর্ট’ বা জীবন্ত শিল্পকলা বলে অবিহিত করছেন।

আরবি ক্যালিগ্রাফির উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে লিপির ভেতর শৃঙ্খলা ও সুচারুবোধের অভাব লক্ষ্য করা যায়। তখন একে প্রশাসনিক কাজেই প্রধানত ব্যবহার করা হত। আরবি লিপি গোলায়িত অর্থাত টানা হাতের পেঁচানো লেখা এবং জ্যামিতিক স্বভাবের দুই বৈশিষ্ট্য নিয়ে উন্নতি লাভ করে। হরফ সঠিক আকার ও আকৃতিতে লেখার পদ্ধতি এবং হরফ পৃথকীকরণ চিহ্ন যাকে নোকতা বলে, তা তখনও বের হয়নি। হরফে হরফে, শব্দে শব্দে, বাক্য, যতি চিহ্ন প্রভৃতি ব্যবহারের বিষয়ে কোন সুষ্পষ্ট বিধি দেখা যায়নি। এবিষয়ে জনমনে দ্বিধা-দ্বন্ধ কাজ করত। বিশেষ করে অনারব বিশ্বে দ্রুত মুসলমাদের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আরবি লিপির ভেতর এসব অসমঞ্জস্যতা দূর করার এবং সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এপ্রেক্ষিতে নোকতা (হরফ পৃথকীকরণ চিহ্ন) এবং তাশকীল (স্বরচিহ্ন) পদ্ধতি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করেন আবুল আসওয়াদ আল দোয়ালী (মৃত্যু-৬৮৮ই.)। এরপর আল খলিল ইবনে আহমদ আল ফারাহিদী (মৃত্যু-৭৮৬ই.) আবুল আসওয়াদের তাশকীল পদ্ধতিকে পুণঃসংস্কার করেন। ১১ শতকের গোড়া থেকে আন্তর্জাতিকভাবে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে এবং এতে ছয়টি স্বরচিহ্ন-কার হচ্ছে : ফাতাহ(আ-কার), দাম্মাহ(উ-কার), কাসরাহ(ই-কার), সুকুন(স্বরচিহ্ন মুক্ত চিহ্ন), সাদ্দাহ(দিত্ত্ব ব্যাঞ্জন বর্ণ চিহ্ন) এবং মাদ্দাহ(স্বরকে দীর্ঘকরণ চিহ্ন), এটা আলিফ প্রয়োগের মাধ্যমেও করা যায়।

উমাইয়া শাসন আমল হচ্ছে আরবি লিপির পরিবর্তনকালীন পর্যায়। কুফী লিপিতে ক্যালিগ্রাফি করা এ সময় পেশায় পরিণত হয়। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান একটি নতুন লিপির আবিস্কার করেন। তিনি এর নাম দেন মানসুব লিপি। উমাইয়াদের একটি স্মরণীয় কীর্তি হচ্ছে, জেরুসালেমে প্রাচীন আল কুদস নগরীতে মসজিদ আল আকসার পাশে কুব্বাতুস সাখরা(ডোম অব রক) মসজিদ নির্মাণ এবং তাতে ক্যালিগ্রাফির যুগান্তকরী প্রয়োগ।

এরপর আব্বাসীয় আমলে আরবি লিপি সৌন্দর্যমণ্ডিত ও উন্নয়ন একই সাথে হতে থাকে।
পর পর তিনজন খলিফার উজির আবু আলী ইবনে মুকলাহ(মৃত্যু-৯৪০ই.) প্রথম আরবি লিপির আনুপাতিক লেখন পদ্ধতি আবিস্কার করেন কোন জ্যামিতিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার না করেই। ইবনে মুকলাহ নাশখ(কপি করা) এবং সুলুস(এক তৃতীয়াংশ) লিপির আধুনিক আকার-আকৃতি রূপায়ন করেন। তিনি গোলায়িত টানা হাতের পেচাঁনো কুফি লিপির উদ্ভাবন করেন এবং তার উত্তরসূরী ইরাকী কুরআন বিশেষেজ্ঞ ক্যালিগ্রাফার আলী বিন হিলাল ইবনে আল বাওয়াব এ লিপির উন্নয়ন করেন।

ক্যালিগ্রাফির ব্যাপক এবং শৈল্পিক প্রয়োগে চমৎকারিত্ব দেখান ফাতেমী খলিফাগণ। প্রাসাদ, মসজিদ, ও সিংহাসন সর্বত্র অঙ্গসজ্জা ও অলংকরণের কাজে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার শিল্পকর্ম হিসেবে গৃহীত হয়। ক্যালিগ্রাফিকে পেশা হিসেবে গ্রহণের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ক্যালিগ্রাফির বিভিন্ন ধারার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সব রকম সুযোগ-সুবিধা সহজলভ্য হয়।



ওসমানীয়দের মিসর দখলের প্রেক্ষাপটে তুর্কীরা নাশখ লিপিতে অসাধারণ শৈল্পিক সুষমা আনয়ন করে। কারণ তুর্কীরা আগে থেকে গ্রীক ও উর্দু হরফের হাতে লেখার সুক্ষ্ম সৌন্দর্য সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল। ১৬ শতকের মধ্যভাগে হাফিজ ওসমান ও আহমদ কারাহিশারি নাশখ লিপিকে সৌন্দর্যের চুড়ান্ত মানে উন্নীত করেন। তুর্কীদের হাত ধরে আরবি ক্যালিগ্রাফি মধ্য এশিয়া, রাশিয়া, আফগানস্তিান এবং মোগলদের হাত ধরে ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

মিসরে আরবি ক্যালিগ্রাফির উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় কাজ হচ্ছে পবিত্র কাবার গিলাফে স্বর্ণতন্তুতে কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি। খেদিভ ইসমাইলের আমন্ত্রণে বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ও নকশা শিল্পী আবদুল্লাহ বেক জুহদী মিসরে আগমন করেন। তিনি কাবার গিলাফ(কিসওয়াহ) বিশেষভাবে নকশা এবং সুলুস লিপিতে ক্যালিগ্রাফি করেন। মিসরে ক্যালিগ্রাফি রেনেসাঁর অগ্রনায়ক হিসেবে তাকে অভিহিত করা হয়। বাদশাহ ফাওয়াদের সময়ে ক্যালিগ্রাফিকে শিল্পকর্ম হিসেবে প্রদর্শনী করা হয়। বিখ্যাত তুর্কী ক্যালিগ্রাফার মুহাম্মদ আবদুল আজিজ মিসরে অবস্থান করে আরবি ক্যালিগ্রাফির একটি ধারা প্রতিষ্ঠা করেন এবং হরফকে স্বর্ণমণ্ডিত করার কৌশল প্রচলন করেন।
.


বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি এবং সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র দশটি জাতীয় ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী করেছে। ক্যালিগ্রাফির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান করছে ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি। এছাড়া ক্যালিগ্রাফি ফাউন্ডেশন, ক্যালিগ্রাফি একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ক্যালিগ্রাফির অঙ্গনে কাজ করে চলেছে। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা সুনাম অর্জন করে চলেছেন। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের শিল্পকর্ম সংগ্রহ করা হচ্ছে বিদেশের বিভিন্ন জাদুঘরে । ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে গবেষণাকর্ম প্রকাশিত ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা হচ্ছে।



তবে সামাজিকভাবে ক্যালিগ্রাফির একটি বড় ধরণের অর্জন হচ্ছে, ক্যালেন্ডার, ভিউকার্ডে এর ব্যাপক ব্যবহার। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম শোভা পাচ্ছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিফট আইটেম হিসেবে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম প্রদান বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি একটি নান্দনিক শিল্পকলা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।




ছবি- অন্তর্জাল থেকে সংগ্রহ।

Sunday, March 4, 2012

মোহাম্মদ জাকারিয়া : ক্যালিগ্রাফি যার প্রেম....





এই ডাকটিকেটটি ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগ প্রকাশ করে। মুসলমানদের ঈদ উৎসব উপলক্ষে ঈদ মুবারক কথাটা আরবি ক্যালিগ্রাফির সুলুস শৈলিতে নকশা করেন আমেরিকার একজন জনপ্রিয় ক্যালিগ্রাফার।

তার নাম মোহাম্মদ জাকারিয়া (Mohamed Zakariya) (আরবিতে- محمد زكريا‎)। তিনি ১৯৪২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ভেনচুরায় জন্মগ্রহণ করেন।


Mohamed Zakariya is a master of Arabic calligraphy. He was born in 1942 in California and trained as an aerospace engineer. In 1961, at the age of 19, a holiday to Morocco changed his life and career. He was fascinated by the culture, religion and language. Zakariya returned to Southern California, and began to learn the Arabic language and to study Islamic calligraphy. He later converted to Islam


বর্তমান সময়ে বিশ্বখ্যাত ক্যালিগ্রাফারদের অন্যতম মোহাম্মদ জাকারিয়া। জীবনের প্রথমদিকে এ্যারোস্পেস প্রকৌশলী হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেও ১৯ বছর বয়সে তার জীবনে মোড় ঘুরে যায়। এ সময় এক ছুটিতে তিনি মরক্কো বেড়াতে আসেন। তার ভেতরে ছিল শিল্পসত্ত্বা, তিনি মরক্কো এসে আরবি ক্যালিগ্রাফি দেখে এতটাই অভিভূত হন যে, এটার প্রেম তার জীবন এবং পেশাকে বদলে দেয়। আরব সংস্কৃতি, ইসলাম এবং আরবি ভাষা তাকে বিমুগ্ধ করে তোলে। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া ফিরে তিনি আরবি ভাষা শিখতে শুরু করেন এবং ইসলামি ক্যালিগ্রাফি হাতে-কলমে আয়ত্ব করা শুরু করেন।

পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।



ক্যালিগ্রাফির প্রতি তার প্রেম আর অধ্যাবসায় এতটা গভীরতা লাভ করে যে, এই শিল্পকলার তত্ত্বীয় ও প্রয়োগিক জ্ঞান লাভের জন্য মরক্কো, স্পেন, ব্রিটিশ মিউজিয়াম ও তুরস্কের ইসলামি আর্ট, ইতিহাস ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রে গমণ করেন।

ওয়াশিংটন ডিসির ফ্রির গ্যালারির ইসলামিক আর্টের কিউরেটরের পরামর্শক্রমে তুরস্কে গিয়ে তিনি ক্যালিগ্রাফির দীক্ষা নেন। ১৯৮৮ সালে তুরস্কে বতর্মান ক্যালিগ্রাফির জীবন্ত কিংবদন্তি উস্তাদ হাসান চালাবির নিকট ক্যালিগ্রাফি শেখা শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে চালাবি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সুলুসনাশখ শৈলির মাস্টার ক্যালিগ্রাফারের সনদ 'ইকাজেট' প্রদান করেন। ক্যালিগ্রাফির বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ এ্যাডভ্যান্স ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন।

তিনি তুরস্কের আরেক বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ড. আলি আল্পসারানের কাছ থেকে তালিক শৈলিতে ইকাজেট লাভ করেন।

১৯৭২ সাল থেকে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাস শুরু করেন। এরপর তুরস্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে তার ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মের প্রদর্শনি এবং এ বিষয়ে বক্তৃতা করেন।




তিনি ১৯৮৭ সালের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় জালি সুলুস শৈলীতে একটি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে ৩য় প্রতিযোগিতায় তিনি একই শৈলীতে ইনসেনটিভ পুরস্কার লাভ করেন। একমাত্র মার্কিন মুসলিম নাগরিক হিসেবে ক্যালিগ্রাফিতে তুর্কী ডিপ্লোমা “ইযাজেত” অর্জন করেন। তিনি আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্যালিগ্রাফির ওপর শিক্ষা প্রদান করেন।

ক্যালিগ্রাফির ওপর লেখা তার দুটি মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে। বই দু’টির নাম হচ্ছে, দ্যা আর্ট এবং অবজার্ভেশনস অন ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি



২০০২ সালে তার নির্মিত ডকুমেন্টরি "Muhammad: Legacy of a Prophet" (2002) প্রচারিত হয়।




তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইসলামি ক্যালিগ্রাফির বিশিষ্ট দূত হিসেবে বিবেচিত।


জাকারিয়ার একটি বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি।


ক্যালিগ্রাফিটি সুলুস শৈলিতে করা হয়েছে। আরবি টেক্সট হচ্ছে- আলাইসাল্লাহু বিকাফিন আবদুহ। অর্থ- আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নন?

আপনারা চাইলে জাকারিয়ায় ওপর একটি চমৎকার ডকুমেন্টরি দেখতে পারেন-









ছবি- নেট থেকে মারিং

জাপানের ক্যালিগ্রাফির জীবন্ত কিংবদন্তি...




১৯৬৯ সালের ঘটনা। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন স্টাডিজের ছাত্র ছিলেন হোণ্ডা। তখন তার মনে হয়েছিল- "আমি কখনও আর একটি আরবি বই খুলব না। আরবি ভাষাকে আমি ঘৃনা করি। ঐ ভাষার অধ্যাপকদের দুই চোখে দেখতে পারি না। কারণ তারা শুধু আরবি ব্যাকরণ পড়ান আর আরবি উপন্যাস, যা পড়াটা ছিল এক প্রকার অসম্ভব কাজ।"

কিন্তু সৌদি আরবে তার প্রথম পাঁচ বছরের কর্ম জীবনে আরবি ভাষার চলিত এবং ঐতিহ্যিক ধরণ আর আরবি হরফের লাবণ্যময় প্রয়োগ দেখে তার শিক্ষাজীবনের পড়াশুনা তাকে আহত করে। হোণ্ডার আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করতে থাকেন।

"প্রতিদিন আমি সুকে (বাজার) যেতাম আর স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জিজ্ঞাসা করতাম, দয়া করে একটু বলেন- এই জিনিসটার নাম কি? এভাবে জিজ্ঞাসা করতাম আর নামগুলো কাতাকানায় (জাপানি হরফ) লিখে ফেলতাম। আমার ধারণা, আমার শিক্ষকরা ছিলেন বোধশক্তির দিক দিয়ে সত্যিকারভাবে সাধারণমানের নাগরিকদের মত, যেমন- ড্রাইভার, কেরানি। তবু তারা ছিলেন টোকিও বিশ্বিবদ্যালয়ের ফরেন স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক।"


হোণ্ডা খুব দ্রুত পেশায় উন্নতি করেন এবং সৌদি তেল মন্ত্রণালয়ের খনিজ-উৎস অনুসন্ধান দলের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তী তিন বছরের সিংহভাগ সময় তিনি মরুভূমিতে কাটান, যেখানে তিনি বেদুইনদের সাথে ঘনিষ্ট সময় অতিবাহিত করেছেন। তিনি প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন ধারণা লাভ করেন।
" আমি প্রকৃতির পালাবদলের প্রতি খুব শ্পর্শকাতর হয়ে পড়ি।"



"যখন আমি দক্ষিণ আরব উপদ্বীপের রুব আল খালি(শূন্য চতুর্থাংশ) এলাকা দেখলাম। মরুর চলমানতার সৌন্দর্য্য আমাকে অভিভূত করে তুলল। জীবন্ত কিছুর মত বালিয়াড়ির প্রাকৃতিক প্রবাহ ছিল সেটা। আমার পদচিহ্নের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মরুর দুরন্ত বাতাস সেখানে শিল্প ফুটিয়ে তুলেছে।"

"আমি মনে করি, আরবি ক্যালিগ্রাফির সাথে মরুর বালিয়াড়ির এই চলমান সৌন্দর্য্যের চমৎকার মিল রয়েছে। আরবি হরফের বৈশিষ্ট্যে শৈল্পিক চলমানতার বিষয়টি আমাকে এতটাই বিদ্ধ করেছিল যে, আমি যখন ফিরে আসি, আমার ভেতরে শুধু দুটো জিনিস আলোড়ন তুলছিল। এক. মরুর বালিয়াড়ির সৌন্দর্য্য আর দুই. আরবি ক্যালিগ্রাফি।


হোণ্ডা তার হৃদয়কে অস্বীকার করতে পারেননি। ১৯৭৯ সালে আবার তিনি আরব সংস্কৃতিতে ফিরে আসেন। ইসলাম গ্রহণ করেন এবং একটি মুসলিম নাম ফুয়াদ(হৃদয়) রাখেন। আরবি ভাষা শিখেন এবং আরবি ক্যালিগ্রাফি শেখায় আত্ননিয়োগ করেন। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে এবং ১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফির দৃশ্যপটে নিজেকে তুলে ধরতে সমর্থ হন।



জাপানি ক্যালিগ্রাফিতে বেজির পশমের তুলি ফুদে(fude) ব্যবহার হয়। হোণ্ডা সেখানে বাশের কঞ্চির কলম (বুসে) ব্যবহার করে জাপানি ক্যালিগ্রাফিতে একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। তার উদ্ভাবিত ধারার নাম- সোডো আরাবি।
shodo ‘arabi—“the way of Arabic writing.”



আরবি ক্যালিগ্রাফিতে "আল খত আল আরাবি" কয়েকটি বিশিষ্ট লিপিশৈলিকে বলা হয়। তেমনি জাপানি সোডো কথাটার অর্থ হচ্ছে- কানা(জাপানি হরফ) অথবা কানজি(চিনা হরফ) লিপিতে আঁকা বিশেষ ধরণের চিত্রলিপি।

বর্তমানে জাপানের সোডো মাস্টাররা(জাপানের ক্যালিগ্রাফির স্বীকৃত উস্তাদ) ফুয়াদ কৌচি হোণ্ডাকে সোডো আরাবির জনক হিসেবে অবিহিত করেছেন।



১৯৯৯ সালে তিনি তুরস্কের উস্তাদ ক্যালিগ্রাফার হাচান চালাবির কাছ থেকে জালি দিওয়ানি(বলিষ্ঠ গোলায়িত আরবি লিপি) শৈলিতে ইযাযা(ডিপ্লোমা) অর্জন করেন। এবিষয়ে তিনি বলেন," আমরা প্রচলিত নীতিমালাকে ভেঙ্গে ফেলতে পারি না, যতক্ষণ না ক্যালিগ্রাফির ঐতিহ্যিক রূপমাধুর্য্যকে আমরা উতরে যেতে পারছি।"



ইউকারি তাকাহাসি, ক্যালিগ্রাফির একজন ছাত্রী, ইয়ামাওকা(সাদা মার্বেল কাগজে কালো কালি দিয়ে লেখা) ও সোডো আরাবি শিখছেন

আরবি ক্যালিগ্রাফির ব্যাপারে জাপানীদের আগ্রহী হয়ে ওঠার পেছনে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ কি? এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক এবং ছাত্রদের কথা ছিল- সৌন্দর্য্য। এর পেছনে একটাই কারণ হচ্ছে সৌন্দর্য্য। আমরা সৌন্দর্য্যে আপ্লুত হই।




টোকিওর আরাবিক ইসলামিক ইনস্টিটিউট

জাপানে আরবি ক্যালিগ্রাফির ইনস্টিটিউট গড়া, সোডো আরাবিকে আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করা, জাপানি ক্যালিগ্রাফারদের মাঝে আলোড়ন তোলা এবং আরবি ক্যালিগ্রাফির সর্বোচ্চ অঙ্গনে জাপানি ছাত্রদের পুরস্কার অর্জনে যার অবদান একান্ত অনস্বীকার্য। তিনি ফুয়াদ কৌচি হোণ্ডা। তার কীর্তি আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফিতে অমর হয়ে থাকবে।

ছবি - নেট থেকে মারিং

Saturday, March 3, 2012

মোহাম্মদ আবদুর রহীমের ক্যালিগ্রাফি অনুশীলন 'রাব্বি যিদনি ইলমা'। Mohammad Abdur Rahim's Calligraphy 'Rabbi Zhidni Ilma'

বাংলাদেশের প্রখ্যাত ক্যালিগ্রাফার মোহাম্মদ আবদুর রহীমের ক্যালিগ্রাফি অনুশীলন 'রাব্বি যিদনি ইলমা'।
Bangladeshi most prominent Calligrapher Mohammad Abdur Rahim's Calligraphy 'Rabbi Zhidni Ilma'